পানির হাহাকার: ৩৯ ঘণ্টায়ও সচল হয়নি পাইপলাইন চট্টগ্রাম নগরীতে!
তুষার দাস, চট্টগ্রাম।
চট্টগ্রামের আকাশে সূর্য উঠেছে ঠিকই, কিন্তু নগরীর হাজারো মানুষের জীবনে নেমে এসেছে তীব্র তৃষ্ণার ছায়া। কর্ণফুলীর জল যেখানে ছিল নগরীর প্রাণ, সেখানে আজ সেই স্রোত থমকে গেছে। কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-১ এর প্রধান সঞ্চালন লাইন ফেটে যাওয়ার পর ৩৯ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও তা সচল করা যায়নি। এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে নগরীর জলজ জীবন।
যেখানে প্রতিদিন কর্ণফুলীর বুকে ভাসত ১৪ কোটি লিটার সুপেয় জল, সেখানে আজ কল খুললেই কেবল শূন্যতার প্রতিধ্বনি। ঘরে ঘরে চলছে পানি সংরক্ষণের যুদ্ধ। পানির অভাবে অনেক পরিবার নিত্যদিনের রান্নাবান্না বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে। চায়ের দোকানের কেতলির তলায় জমে থাকা শেষ ফোঁটা জলও যেন মহামূল্যবান হয়ে উঠেছে।
নগরীর রাস্তায় এক অদ্ভুত দৃশ্য—বালতি, কলসি, বোতল হাতে মানুষের দীর্ঘ লাইন। কেউ কেউ প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে একটু পানি ধার করছেন, আবার কেউ ওয়াসার ট্যাঙ্কারের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন।
বায়েজিদ এলাকার লুবনা আক্তার নামের এক গৃহবধূ বললেন, “সকাল থেকে সারা পাড়া ঘুরে এক বালতি পানিও পেলাম না। জীবন যেন অচল হয়ে গেছে!”
অপরদিকে, বৃদ্ধ আব্দুল খালেক আক্ষেপের সুরে বলেন, “এই বয়সে পানি খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে গেছি। যে নগরীতে কর্ণফুলী বয়ে চলে, সেখানে মানুষের তৃষ্ণার্ত থাকা কি মানায়?”
সোমবার নগরীর অক্সিজেন-কুয়াইশ সংযোগ সড়কে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ চলছিল। সেই কাজের মাঝেই স্কেভেটরের এক অঘাতেই ফেটে যায় ওয়াসার চার ফুট ব্যাসার্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ সঞ্চালন পাইপ। মুহূর্তের মধ্যেই প্রবল গতিতে ছুটে আসা পানিতে চারপাশ সয়লাব হয়ে যায়।
খবর পেয়েই ওয়াসার প্রকৌশলীরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান এবং পানি সরবরাহ বন্ধ করেন। কিন্তু এ বন্ধই যেন নগরীর জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম সময়ের কণ্ঠস্বর’কে জানিয়েছেন, অক্সিজেন-কুয়াইশ সংযোগ সড়কের অনন্যা আবাসিক এলাকার কাছে কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-১-এর সঞ্চালন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের কর্মীরা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আজ বুধবার সন্ধ্যায় পানি সরবরাহ পুনরায় চালু হতে পারে। তবে পাইপের ভেতরে বড় কোনো জটিলতা থেকে গেলে এই সময়সীমা আরও দীর্ঘায়িত হবে।
কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-২ সচল থাকলেও সেটি পুরো নগরীর জলতৃষ্ণা মেটাতে যথেষ্ট নয়। ফলে বৃহত্তর হালিশহর, আগ্রাবাদ, জামালখান, লালখানবাজার, মাদারবাড়ি, জিইসি, মুরাদপুর, কদমতলী, ধনিয়ালপাড়া, নয়াবাজার, ষোলশহর ২নং গেট, বায়েজিদ, অক্সিজেন, চকবাজার, নন্দনকানন, সিরাজদৌল্লাহ রোডসহ অনেক এলাকায় পানির সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে।
যে নগরীর প্রতিটি গলিতে একসময় কল খুললেই স্বচ্ছ পানি ঝরত, আজ সেখানে এক ফোঁটা জলের জন্য হাহাকার।
রাঙ্গুনিয়ার পোমরা এলাকায় কর্ণফুলীর বুক চিরে চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিদিন ২৮ কোটি লিটার পানি উত্তোলন করে নগরীর চাহিদা মেটায়। এর মধ্যে প্রকল্প-১ থেকেই আসে ১৪ কোটি লিটার। তাই এই সঞ্চালন লাইন অচল হওয়ায় পুরো ব্যবস্থাপনা এক বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের সঙ্কট কি অবশ্যম্ভাবী? উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের সময় কেন এত গুরুত্বপূর্ণ একটি পাইপলাইনের সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়নি? কেন এত বড় একটি দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়নি? নগরীর জল সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে আরও কৌশলী পরিকল্পনা ও কার্যকর সমন্বয় প্রয়োজন। উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের সময় পানির লাইনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা না ঘটে।