ত্রিপুরাদের বৈসু উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী নৃত্যে শোভাযাত্রা।
থানচি (বান্দরবান) প্রতিনিধি: মথি ত্রিপুরা ।
বৈসু ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের প্রধান সামাজিক উৎসব। তিন দিন ধরে এই উৎসব পালিত হয়। এই তিন দিনের জন্য আলাদা নাম রয়েছে। যেমন- প্রথম দিনের নাম "হারি বৈসু" দ্বিতীয় দিনের নাম "বৈসুমা" এবং তৃতীয় দিনের নাম "বসিকাতাল"। পুরনো বছরকে বিদায় নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর ঐতিহ্যবাহী ত্রিপুরাদের সামাজিক উৎসব হলো বৈসু। বান্দরবানের থানচিতে যথাযোগ্য মর্যাদায় বৈসু উৎসব উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী নৃত্যে শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সোমবার সকালে নববর্ষে বসিকাতাল উপলক্ষে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বর্ষবরণ উৎসব উপলক্ষে নতুন বছরকে বরণ করে নিতে নৃত্যের শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। ডাকছৈ পাড়া হতে র্যালি শুরু করে নিবেদিতা কুমারী মারিয়া ধর্মপল্লীতে এসে শেষ হয়। নতুন বছরকে বরণ করে নিতে শত শত নারী পুরুষ নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে গড়াইয়া নৃত্যের তালে তালে নেচে গেয়ে র্যালিতে অংশগ্রহণ করেন। বৈসু উৎসব উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভায় বৈসু উদযাপন কমিটি সভাপতি বার্নাড ত্রিপুরা সভাপতিত্বে, প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, জেলা পরিষদের সদস্য ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান খামলাই ম্রো। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, নিবেদিতা কুমারী মারিয়া ধর্মপল্লী পাল পুরোহিত ফাদার শীতল ডি রোজারিও সিএসসি, সহকারী পাল পুরোহিত ফাদার সমীর পিটার ডি রোজারিও সিএসসি, ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার পিতরাং ত্রিপুরা, সিস্টার রোজ সুলেখা চাম্বুগং আরএডিএম, প্রধান শিক্ষক মনিরাম রাফায়েল ত্রিপুরা ও সিস্টার বেনেডিক্টা পেরেরা আরএডিএম প্রমুখ।
এই নিয়ে হালিরাম পাড়া কারবারি ও ইউপি সদস্য পিতরাং ত্রিপুরা বলেন, বৈসুর প্রথম দিনকে হারি বৈসু বলে। হারি বৈসু দিন ত্রিপুরা নারীরা পাড়ার মহল্লায় বিন্নি চাল গুঁড়ো করে তা দিয়ে পিঠা তৈরি করে। এই দিন ত্রিপুরা নারীরা পরিবারে ব্যবহার্য যাবতীয় কাপড়-চোপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে ফেলে। গ্রামের যুবক যুবতীরা সেদিন খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ফুল সংগ্রহ করে ফুল দিয়ে বাড়িঘর সাজায়। ঘরের কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করার মধ্য দিয়ে পুরনো বছরের যাবতীয় বিপদ-আপদ, জঞ্জাল ও দুঃখ-বেদনা ধুয়ে মুছে যাবে বলে বিশ্বাস। গরাইয়া নৃত্যে নারী পুরুষ গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে ঢাক-ঢোল-বাঁশি বাজিয়ে গরাইয়া নৃত্য পরিবেশন করে।
বৈসু উদযাপন কমিটি সভাপতি বানার্ড ত্রিপুরা বলেন, বৈসু দ্বিতীয় দিন বৈসুমার দিনটি ত্রিপুরাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। কারণ এই দিনে ত্রিপুরা সমাজে মানুষেরা ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একে অপরের বাড়িতে বেড়াতে যায়। সামর্থ্য অনুযায়ী নানা ধরনের পিঠা, সরবত ও অন্যান্য খাবার অতিথিদের পরিবেশন করা হয়। তবে বৈসুমা'র দিনে প্রাণী মারা নিষিদ্ধ হওয়ায় ঐদিন নিরামিষ ভোজন করে সবাই। গরাইয়া নৃত্য পরিবেশন ছাড়াও ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন খেলাধুলা সারাদিন ধরে চলে।
কমলা বাগান ত্রিপুরা পাড়া কারবারি প্রেমুজ ত্রিপুরা বলেন, বৈসু তৃতীয় দিনে বসিকাতাল নববর্ষকে স্বাগত জানানোর দিন। শিশু-কিশোর ও যুবক-যুবতীরা নতুন কাপড়-চোপড় পরিধান করে গ্রামের ঘরে ঘরে গিয়ে হাঁস-মুরগি এবং অন্যান্য পশু-পাখির জন্য খাবার বিলিয়ে দেয় এই দিনে। ত্রিপুরাদের সামাজিক রীতি অনুসারে ছোটরা বয়স্কদের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ গ্রহণ করে। গ্রামের যুবক-যুবতী ও নবদম্পতিরা পানি তুলে এনে গ্রামের বয়স্কদের স্নান করায় এবং আশীর্বাদ গ্রহণ করে। পরিবারের মঙ্গলের জন্য সৃষ্টিকর্তা কাছে প্রার্থনা করে। নববর্ষে দিনে অতিথি আপ্যায়ন করতে পারাতায় গৃহস্থের জন্য মঙ্গলজনক বলে ধরে নেয় ত্রিপুরারা।